Monday, April 21, 2008

Chikitsa Bibhrat

“বসবার জায়গা আছে।”
হ্যাঁ, প্লিজ বসুন, যদি দয়া করে আমার এই গল্প শুনতে এসে থাকেন। সাধারণত, ব্লগে গল্প লেখা হয়না। তবু লিখছি। কেন, পড়লে হয়ত বুঝবেন:


আমি একজন ছাত্র। কলেজে পড়ি। হস্টেলে থাকিনা যদিও, তবুও প্রায়ই যাই। হয় treat থাকলে, নয়ত ডাউনলোড করা কোন সিনেমা নেবার হলে। বন্ধুরা বলে, আমার রুচি নাকি খুব খারাপ, শুধু আল ফাল “আপনা সপনা মানি মানি” মার্কা ফিলিম ছাড়া আর কিছু দেখিনা। কি করব বলুন, সব জিনিস তো সবার ধাতে সয় না। যে ক্লাসিকাল সঙ্গীত শুনলে মনে হয় কেউ কায়দা করে গার্গল করছে, তা শুনে কেন ভাল লাগবে বলুন দিকি। যাক সে, এটা কিন্তু ঠিক যে আমি ভাল অভিনেতা। বিষেশত হিরো। (ওহ্‌, বানান দেখে চমকে উঠলেন বুঝি? ও আমার একটু-আধটু অমন হয়ে যায়।) অবশ্য দেবানন্দ মার্কা নয়, ঋত্বিক মার্কা। যদিও দেবানন্দ শাহরুখ অমিতাভ সকলের ভালই নকল নামাই। কবে থেকে শখ, নিজে পরিচালক হয়ে এমন একটা সিনেমা বানাবো, নিজের হিরোত্ব পুরো unleash করে দেব। অন্যের শাসনে থেকে অভিনয়ে সুখ নেই। একটু মনপসন্দ কায়দা-কেতা (নিন্দুকে বলে ছ্যাবলামো) করা যায় না। তাই এবার হস্টেলের নাটকের অনুষ্ঠান “স্পটলাইট”-এর কথা শুনতেই মনে হল, এ-ই সেই, শেষ সুযোগ। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, আর তো হবেনা। ঠিক করলাম, যত বড় বড় হিরো আছে দুনিয়ার, সবার থেকে নিয়ে একটা কিছু নামাতে হবে। ডন, কৃশ, সুপারম্যান, শোলে, হ্যারি পটার, রেস, গোলমাল (নতুনটা, অবশ্যই), মুন্নাভাই, এইরকম সব মিলিয়ে। শুনে বন্ধুরা অনেক হ্যাটা দিল। “বলিস, এখন বার্ড ফ্লুর এত ছড়াছড়ি, কেউ দয়া করে (পচা) ডিম ছুঁড়বেন না”; “একটা ডালির ব্যবস্থা করিস, পুজোর অঞ্জলির মত, যারা যারা জুতো ছুঁড়তে চাইবে তারা যেন আলাদা করে না ছুঁড়ে ঝামেলা না বানায়, ডালি সবার কাছে যাবে, তাতে দিয়ে দেয়, আমরা ছুঁড়ে দেব”; “অনুরোধ করিস, কেউ একপাটি ছুঁড়বেন না, আপনাদেরও লাভ হয় না, আমাদেরও না, দিলে দুপাটি-ই দেবেন” এইসব। আরে, তোরা কি এসবের মর্ম বুঝবি? তাহলে তো তোরাই হিরো হয়ে যেতি রে। রোজ রাত্রে যে তিনটে করে আমেরিকান পাই দেখে ছটায় শুতে গেছি, সে কি আর এমনি এমনি? Film awareness নইলে আসবে কি করে?
“খোশনবীসপুত্র একখানি নাটকের সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখিয়াছেন বটে; নায়িকার নাম চন্দ্রকলা কি শশিরম্ভা ... – তাঁহার পিতা বিজয়পুরের রাজা ভীমসিংহ, আর নায়ক একটা কিছু সিংহ; এবং শেষ অঙ্কে শশিরম্ভা নায়কের বুকে ছুরি মারিয়া আপনি হা হতোস্মি করিয়া পুড়িয়া মরিবেন, এই সকল স্থির করিয়াছেন। কিন্তু নাটকের আদ্য ও মধ্যভাগ কি প্রকার হইবে, এবং অন্যান্য নাটকোল্লিখিত ব্যক্তিগণ কিরূপ করিবেন, তাহা কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই। ... শেষে একটি গীতও দিয়াছেন – নায়িকা ছুরি হস্তে করিয়া গায়িতেছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে নাটকের অন্যান্য অংশ কিছুই লেখা হয় নাই।”
আমার অবস্থাও ঠিক এরকম হল – আইডিয়া কিছুতেই প্লটে কনভার্ট হল না। তাই দেখে কৌশিক, আমার ক্লাসমেট, একদিন ঐটা ‘কমলাকান্তের পত্র’ থেকে শোনাল, যে “দ্যাখ জগু, দিন তো এসে গেল, এখনো এইভাবে বসে থাকলে শেষে কিছুই নামবে না।” ধনঞ্জয়, আরেক বন্ধু, ও তাই বলল। শেষে দেখি, যা ভয় করেছিলাম তাই, এরা দুজনে সব পুরনো বাংলা গল্প-নাটক নিয়ে বসে পড়েছে। একটা করে বলে, একটু করে অ্যাক্টো করে, আর আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি কি বুঝবো? আমার কাছে তো সবই সমান, সবই পচা। এটা অনেকেই বলেছিল, আমিও চেয়েছিলাম, যে কমেডি হোক, লোকে মজাও বেশি পাবে, আর সিরিয়াস অ্যাক্টিং আমাদের দিয়ে হবেও না – কারন আমার পণ ছিল যারা কোনদিন আগের হোস্টেল নাটকগুলোয় নামেনি তাদের দিয়েই করাব – যদিও মহত্ব দেখাচ্ছিলাম তবুও আসল কারন এই যে ভাল অ্যাক্টররা আমায় বিশেষ কলকে দিত না। শেষ মেশ মনোজ মিত্রের একটা লেখা, ভীম বধ, আর চিকিৎসা সঙ্কট এর মধ্যে আমি choose করলাম লাস্টেরটা। আমার সাজানো পেল্যান শুকিয়ে গেল, কিন্তু কি আর করা।
ভেবেছিলাম হিরোর রোলটা নেবো, তবে পরিচালনার সঙ্গে মেন রোল করা একটু চাপ বলে, আর একটু ভদ্রতা/সঙ্কোচ বশত, একটু বিনয় করছিলাম। ওমা, দেখি তক্ষুনি ধনা আমাদের ব্যাচের অন্য একজনকে কাস্ট করে দিল! আমার ভাগ্যে জুটল শুধু ষষ্ঠীবুড়োর রোল। কৌশিক পাজিটাকে মধু চাকরের রোলে দিয়ে অবশ্য একটু মনের জ্বালা মেটালাম। চাকরের রোল কেউ করতে চায়না – গত দুবার নাটকে (যখন আমি দর্শক) যে-ই চাকরের রোল পেয়েছে, শেষ দিন বাড়ি পালিয়ে গিয়ে অন্যদের সমস্যায় ফেলেছে। অবশ্য এবার ও এমন ভাবে জড়িয়ে ছিল যে পালাতে পারবেনা, এই আশায় ছিলাম। পালায়ও নি।
আমাদের ব্যাচের মাইয়াগুলান কেউ রাজি হল না। শেষে হস্টেলাররাই একজন রিসার্চ ফেলো দিদি (বিপুলা), আর একজন অন্য ব্যাচের মেয়ে (পিসিমা) কে ধরে আনল। দ্বিতীয় জনের অভিনয় রিডিং এর থেকে বেশি আর ওঠে না। কি চাপ। অন্য কাস্টিং মোটামুটি হয়ে গেল। তার পর হল মহা ঝামেলা। বঙ্কু পয়লা বৈশাখ এর জন্য একহপ্তা মামাবাড়ি যাবে, নো প্রাক্টিস, পদত্যাগ। নিধু মুম্বাই তে চাকরির ইন্টারভিউ খারাপ দিয়ে, মনের দুঃখে রোল করবেনা বলে বাড়ি চলে গেল। পিসিমা’র ঘরে জানলা দিয়ে চুরি হলে সেও বাড়ি পালাল। নন্দ, মেন রোল, সেও বন্ধুদের প্যাঁক খেয়ে রিজাইন করল। তাকে substitute করা হল, কিন্তু নতুন ছেলেটি সেই meek ভাবটা আনতেই পারেনা। নন্দ মেলেনা, পিসিমাও না। এদিকে পুরনো দিনের গল্পের সাথে মেলান পুরোন মেজাজ, হাবভাব আনতে পারিনা, ডিরেকশন দেব কি? মনের দুঃখে:

আমার স্ক্রিপ্ট না নামিল,
ট্রেনিংও ঝুলিল,
দিন যে আসিয়া যায় মা।
স্পটলাইটেতে কি যে নামাব
বুঝতে পারিনা হায় মা।

ধনা-টার চাপে স্টোরি তো ভুলেছি,
রোলটাও বড় বিশ্রী পেয়েছি;
কৌ’ পাজি করে বড় সর্দারি,
আর না সহ্য হয় মা।

কাস্টিঙে দেখি ঝামেলা তো ভারি,
সেট, মেকাপেও বড় বাড়াবাড়ি;
একটু ঢোকাতে চাই ছ্যাবলামো,
সেই সুযোগও না পাই মা।

ছেলেগুলো অ্যাক্টিং তো জানেনা
ডায়লগও মনে রাখতে পারেনা–
যেথা নেই পচা ডিম বা টমেটো
সেথা যেতে প্রাণ চায় মা।

লোকজন বলল, এরকম তো হবেই। সবাই নতুন অ্যাক্টর, অভিজ্ঞতা নেই, দক্ষতা নেই, সাহস ও নেই। আর ওদিকে কৌশিক আর ধনঞ্জয় বড় পারফেকশনিস্ট, খুব খুঁতখুঁত করে। কাস্টের ঠিক নেই, কৌশিক ছোঁড়া হঁকো, গড়গড়া, রঙ্গিন দাড়ি, ডাক্তারদের পোস্টার, হাকিমের টুপি সব বানিয়ে ফেলল। যদিও ভাল বানায়, তবুও, স্বীকার করতে আছে, বলুন? লাই পেয়ে যাবে না?
হাকিমের আলখাল্লা জোগাড় করতে গেলাম কলেজের অফিসে, সমাবর্তন (বাপরে) এর জোব্বা চাইতে। শুনলাম, সদ্য কাচতে দেওয়া হয়েছে, মেরামত হবে, তবে আসবে। আমাদের পাঁশুটে মুখ দেখে ওরাই বলল, বিদেশি স্টুডেন্টদের অফিসে যাও, ওদেরও একসেট থাকে। গেলাম, চাইলাম। বলল, কি করবে? যেই শুনল, হাকিমের পোষাক, আমায় বকে দিল। না, হাকিমের জন্য কেউ রংচঙে ড্রেস দেয়? কালো কোট চাই। তখুনি এক জন উকিল বন্ধুকে ফোন করে তার কাছ থেকে চাইল, বলল পরের দিন এসে নিয়ে যেও। কৌশিক শুনে পরে বলে কি, ওটা ওরা বিচারক হাকিম ভেবেছে, চিকিৎসক হাকিম নয়। কি গেরো! এই জন্যেই এইসব পুরোন জিনিস করতে চাইনা। যাহোক, গিয়ে আবার বললাম, এবার ঠিক করে।
আমার ডাস্টবিন-প্রীতি আছে, অনেকে জানে। ভাগ্যক্রমে হবৌ (হবু+বৌ) বিশ্বাস করে না। সেই রাজধানী এক্সপ্রেসে খেতে-ভুলে-যাওয়া সিঙ্গাড়াটা তুলে আনতে যে সাফাইকর্মীর পিছনে ছুটেছিলাম, জানেনা হয়ত। এবারও, মোহর বানাতে কৌশিক কিছু সোনালি কাগজ কিনে আনতে বলেছিল। কাটালাম। তার বদলে, হোস্টেলের ডাস্টবিন ঘেঁটে বার করলাম অনেকগুলো সিগ্রেটের প্যাকেট, তার সোনালি রাংতা দিয়েই বানানো হল।

লোকজন মনের সুখে বান্ধবী, বাড়ি সবেতে সময় দেয়, কিন্তু রিহার্সালে ফাঁকি। অরিজিৎ আগে মুখে না না করছিল, কিন্তু এত লোক, এত মেয়ে দেখে শেষে একটু ছদ্ম গাঁইগুঁই করে বঙ্কু করতে রাজি হয়ে গেল। ওদিকে দিন এসে গেল। বিপুলাদি এক দিদি কে ধরে এনেছিল, সে বলল ইমেলে স্ক্রিপ্ট পাঠাতে। টেনশনে ভুল করে আমি অমিতার বদলে অনিতা লিখে মেল করে দিয়েছি। পিসিমা আগের দিন বিকেলে ফোন করে বলল, কিরে, আমায় লাগবে না তো? তখন রহস্য উদ্ঘাটন হল। ভাগ্যিস পিসিমা দারুন অ্যাক্টর, তাই বেঁচে গেলাম। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ায় মধুর সঙ্গে তার কোন রিহার্সালই হল না। এ নিয়ে পরে মুশকিল হয়েছিল, পরে বলব।
আগের দিনও নিধু পাইনা, হকার পাইনা। হকার লাগবে, কারন, ট্রাম থেকে পড়া তো আর দেখাতে পারি না, পড়ার যুতসই কারন চাই। কৌশিক বলল, একটা মাতাল রাখিস, নন্দ পড়ে গেলে মাতালই বলবে, এ ব্যাটা মাতাল। আর আমি ভেবেছিলাম, স্টেজে সাইকেল তুলব, চালক কেতরে কেতরে যাবে ওটায় চড়ে। তারপর হকার, নন্দ, মাতাল, সাইকেল একসাথে ধাক্কা। টিপিক্যাল ‘হেরা ফেরি’ প্লট। অনেকে বারন করল। বলল, এরম কর, নন্দ বঙ্কুকে ডাকতে গিয়ে হকারের মাল পাড়িয়ে দেবে, সে ঠেলে দেবে, তখন মাতালের সাথে ধাক্কা হবে। মনোকষ্টে রাজি হলাম। আমি যেন ডাইরেক্টরই নই, যে যা পাচ্ছে মত চালাচ্ছে। আরে, হস্টেলের ছেলেরা কি পছন্দ করে আমি জানি, ওখান থেকেই তো আমেরিকান পাই পাই। শুনল না, বলে এই বয়সে আর স্ল্যাপস্টিক কমেডি করতে ইচ্ছা করেনা। সেটা কি, কে জানে।

লোকেদের চাপে শেষ দিন সকালে আমাদের ব্যাচের বাঘ অ্যাক্টরদের ধরতেই হল। রাজিও হয়ে গেল। নিধে আর হকার। নিধের একটা গান লেখা হয়েছিল। বেজিং থেকে সেটা লিখে পাঠিয়েছিলেন লন্ডনবাসী এক দাদা যাঁর আগে দিল্লিতে ব্যাণ্ড ছিল। সেটা নিধে একটু অন্য সুরে, অল্প কথা বদলে খাসা তুলে ফেলল।
মেকাপও প্রায় হয়ে এল। আমি নেহাৎ নিজের শাল আনতে ভুলে গেছিলাম, তাই শুধু মাঙ্কিক্যাপ পরেছিলাম। আচ্ছা, এত কিছু একসাথে করা যায়? এটা ভিডিও শুট হয়, যদিও ক্যামেরাম্যান খুব বাজে। গত বার, স্টেজের দু হাফে আলেকজান্ডার আর পুরু, ক্যামেরা শুধু পুরুর উপর। আলেক্স-এর চুল খোলা ওঠেইনি। কৌশিক কে বললাম, তোর তো মাত্র দুটো সিন, তুই-ই ক্যামেরা টা দেখিস। ও বলল, আমাকে তো সেট সাজাতেই হবে, আমারি হাতে বানানো প্রপ্‌ সব। বললাম, সে অনেক লোক আছে, যদিও আসলে কাউকেই পাই নি। তার সাথে বলেছিলাম, লাইট আর মিউসিকটাও তুই একটু সামলে দিস। পারলনা, জানেন! কিরকম ফাঁকিবাজ বলুন দেখি! যদিও সিন-বাই-সিন মিউসিক ইনস্ট্রাকশন সব লিখে ল্যাপটপ অপারেটর (রেকর্ডের সানাই বা ইসলামি মিউসিকের জন্য) আর কীবোর্ড বাদক এর জন্য ও দিয়েছিল, আমি একটা হারিয়ে ফেলি। দুজনকে একটা দিয়েই চালাতে হয়। আচ্ছা দেখুন, হাকিমের সিনে “খাজা মেরে খাজা” বাজালে পাবলিক হাসত না? বলল যে, একে ডাক্তার তায় ফ্রড, ধার্মিক হতে পারে না, বাজাস না। মানে নাই বা হল, লোকে হাসানোই তো উদ্দেশ্য। মূর্খ!

শেষ দিকে নন্দ বিপুলা মল্লিকের চেম্বারে যাবে, তারপর দুজনের দুজনকে পছন্দ হবে, তারপর বিয়ে; তবে আড্ডাটা উঠে যাবে। বিয়ে দেখানো ঝামেলা বলে স্ক্রিপ্টে ঠিক হল, প্রথমবার নন্দ উঠে আসার পর ‘সফট্‌ লাইট’ হবে, বার দুয়েক নন্দ যাতায়াত করবে, শেষে দুজনে হাত ধরবে, আর সানাই বেজে উঠবে। লাস্ট সিনে লোকজন খেয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলবে, আমাদের আড্ডাটা ঘুচল। কৌশিক স্ক্রিপ্ট লিখেছিল, আমাদের থেকে input নিয়ে, ওকে জিগাইলাম, সফট্‌ লাইট মানে তুই কি বলছিস। মানল, হ্যাঁ, ওটা clearly লেখা হয়নি, ওখানে কোন রঙিন আলো দিয়ে দিস।
বিপুলাদি দারুন অভিনয় করে, তায় আবার এ বিষয়ে জ্ঞানও আচ্ছে – বলল, এক কাজ কর, প্রথমবার নন্দ হাতে প্রেসক্রিপশন নিয়ে যাবে, আর ফেরত দিয়ে দেবে, কারন ওকে দেখেই তো সব অসুখ চলে গেছে। আর দ্বিতীয়বার গোলাপ নিয়ে যাবে, গোলাপের উপর দুজনে হাত ধরবে। খাসা প্ল্যান। আবার একটা গানও বলল, যার দুটো line দুবার যাতায়াতের জন্য খুব appropriate:
“কেটেছে একেলা বিরহের বেলা, আকাশ কুসুম চয়নে,
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে, তোমারি দুখানি নয়নে।”
গানের শেষে আরো দুবার নয়নে বলা আছে, সেই অনুযায়ী অভিনয় synchronize করা হল। আমি কৌশিককে বললাম, গানটা আর সানাইটা জুড়ে দে, ল্যাপু অপারেটর যদি পরপর প্লে করতে না পারে। গাঁইগুঁই করছিল, তবু করে দিল। লাল গোলাপ কিনে আনা হয়েছিল, দিব্যি practice হল, কিন্তু কয়েক ঘন্টা পর স্টেজে নামতে গিয়ে দেখি সে গোলাপ নেতিয়ে গেছে, জলে রাখা হয়নি বলে। যাচ্চলে। ওটা ছাড়াই করা স্থির হল।
আমি আর কৌশিক হাকিম, মীরমুন্সী, বল্‌বর আর নন্দকে practice করিয়ে খেতে গেছিলাম। এসে দেখি ওরা সিন চেঞ্জ করে ফেলেছে! নন্দ সেই শান্ত ভীতু ভাবে “রোগটা কি, সেটা জানতেই তো আসা বাপু” ছেড়ে উদ্ধত রাগত বিরক্ত ভাবে বলছে, “আরে, রোগটা জানলে কি এখানে আসতাম নাকি?” হাকিমও, নন্দ “বন্দেগি জনাব” বলার বা নজরানা দেবার আগেই “খামোশ” বলে চিৎকার করে উঠছে। শেষে মাথা কামাবার বদলে সবাই নন্দকে ধরে ঠ্যাঙ্গাচ্ছে; নন্দ বলছে, “ছেড়ে দাও, বল কত টাকা চাও”; এর মাঝে মীরমুন্সী আবার ষষ্ঠীবুড়োর লাঠিটা বাগিয়েছে, তাই দিয়ে নন্দর ঠ্যাং টানা হচ্ছে। কৌশিক দেখেশুনে বেশ খেপে গেল। আমায় বলছে, ডাইরেক্টর, কিছু বলো এদের। কি বলব, আমার তো বেশ মজাই লাগছে, এত দিন যে ভাটের আশায় ছিলাম, প্রথমবার তা দেখতে পাচ্ছি। আবার কৌশিকের ভয়ে বলতেও পারছি না, যে এটাই হোক। সে-ই অনেক ঝগড়া করে ওই পরিবর্তিত সিন বাদ দেওয়াল। আমরা পাঁচ জনেই বেশ দুঃখিত হলাম। হাকিম তো গোড়া থেকেই বলছিল, “কুছ্‌ অরিজিনালটি লাও ইয়ার। উও ভুলভুলাইয়া জ্যায়সা স্যাফ্রন পহ্‌না রোল দো মেরা।” তাতেও কৌশিকের আপত্তি – “অন্য একটা সিনেমা থেকে ডিরেক্টলি একটা রোল কপি করে আনা কি করে অরিজিনালটি হবে?”
তবে তার জমকালো প্রপ্‌স্‌ – টুপি, লাল ভেলভেটের আলখাল্লা, সাদা-লাল-নীল তিনরঙা দাড়ি, তারা কাটা পেতলের আতরদান, আর চমকদার গড়গড়া দেখে হাকিম খুশি হয়ে গেল। গড়গড়াটা কাগজ আর প্লাস্টিক দিয়ে বানানো, হাওয়ায় পড়ে যাচ্ছিল বলে বালি ভরে ভারি করে টেস্ট করতে গিয়ে কৌশিক ভুলে কখন সত্যি টেনে ফেলেছে, মুখে বালি ঢুকে কেশে অস্থির।

হকার তার প্রথম রিহার্সাল দিতে আসে এক নাটকের এক ঘন্টা আগে। তখন খবর শুনে আক্কেল গুড়ুম – আমাদের দ্বিতীয় মাড়োয়ারী তখনও বাড়ী থেকে বেরোয়নি – আর সে না এলে নন্দপতন সিনে ডায়লগের flow ঘেঁটে যাচ্ছে। তবুও তার মধ্যেই শুধু পড়াটুকু practice হল। হকার রিহার্সাল দিতে বসেছিল জুতোর ঢিপির পাশে, তাই ঠিক হল সে জুতোই বেচবে। রিহার্সাল হয়ে গেল, এরপর স্টেজে উঠে হল মুশকিল। দ্বিতীয় মাড়োয়ারী এসেছে নাটক শুরুর ঠিক আগে। এসে ব্যাপারটা শুনে নিয়েই স্টেজে উঠে গেছে। সেখানে হকারের সঙ্গে বড় আলোচনা জুড়ে দিয়েছে – কোন জুতো কেমন, সস্তা কত, নতুন না সেকেন্ডহ্যান্ড এসব। হকারেরও খেয়াল নেই, কথা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে নন্দ বিছানো জুতোর উপর উঠে পড়েছে, হকার আর ক্রেতার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে; একবার অডিয়েন্স, একবার হকার, একবার মাতাল, আর একবার আমার দিকে চায়; কিন্তু হকার আর ঠেলা দেয়না, বেচায় ভীষন ব্যস্ত। আমরা ইশারা করছি, ওরে ঠেল, ঠেল, হকার শোনে না। মাতাল খানিক দূরে দাঁড়িয়ে লটরচটর করছে, নন্দ ঠেলা খেলেই তো সে ছুটে আসবে ধাক্কা দিতে, নইলে পড়বে কেন। এমন সময় হঠাৎ হকারের হুঁশ হলে, “এই, হ্যাঁ, সরে যান”, বলে ঠেলে দিল। মাতাল তাড়াতাড়ি ছুটে আসতে গেল, পুরোটা পারলনা, নন্দ খানিকটা এমনি এমনি গোঁজামিল দিয়ে পড়ে গেল।
এমন চমৎকার উদ্বোধনের ধারা বোধহয় পরের সিনেও continue করছিল। চিত্রশিল্পী (বন্ধুর বাবা)-র পরামর্শ অনুযায়ী নন্দর বাবা’র ছবি লাগানো হয়েছিল পিন দিয়ে, পেছনের কাপড়ে। লাগাতে না লাগাতেই হাওয়ায় ঠপাস করে খুলে পড়ে গেল। ভাগ্যিস তখনো আলো জ্বলেনি। সেলোটেপ দিয়ে লাগানো হল (আর্ট ডিরেক্টরের নাকি কাঁচি হাপিস, দাঁত দিয়ে কাটতে হল)। এরপর সিনে, পিসিমা “কাশী টেনে নাও ঠাকুর” বলে পিছন ফিরেছে, মধু এসে ডেকেছে, “পিসিমা, চিনি চাই”। কৌশিক নাকি স্ক্রিপ্ট হারিয়ে ফেলায় পিসিমার কোন ডায়লগের পর উঠবে ধরতে পারেনি, ভুল সময়ে উঠে পড়ে থতমত খেয়ে গেছিল, সুন্দর continue করা লাইন “ঠাকুর চিনি চাইছে পিসিমা” না বলে ওটা বলে ফেলেছে। ছোঁড়া আরও ভেবলে গেল, যখন দেখে পিসিমা ফিরে ডায়লগ বলছে না। আবার চেঁচাল, “পিসিমা”, তবুও সাড়া পায় না। পরে বলল যে, তখন নাকি লাইন চেঞ্জ করে বলতে যাচ্ছিল, “পিসিমা, অনেক তো বয়স হল, এবার কানের যন্তর কিনুন।” তখনই পিসিমাকে ফিরতে দেখে চেপে গিয়ে আসল ডায়লগ বলেছে। নন্দরা গোপনে পরামর্শ করেছিল, কিছু অরিজিনালিটি ওরা ঢোকাবে অনস্টেজ, যেমন মধুকে হ্যাটা দেওয়া ইত্যাদি। শুরু থেকেই এমন কীর্তি হতে থাকায় আর পারেনি।

বাঙাল বেটা রোল করতে হবে শুনেই বাড়ি পালিয়ে গেল। কোবরেজ যে করছিল সে পাক্কা ঘটি। তার উচ্চারন অনেক কষ্টে কিছু দুরুস্ত্‌ হলেও অভিনয় ভালো ছিল না। আর “দেখ দেখ বিড়েলে সবটা ছাগলাদ্য ঘৃত খেয়ে গেল” এর বদলে খালি “দেখ দেখ ছাগলে সবটা... উম... ইস্‌” করছিল। স্টেজে যদিও তা করেনি, তবে দৌড়ালো ঠিক পেছন দিকে, গল্পের ঠিক উলটো, যেখানে বিড়াল থাকলে ও দেখতেই পাবেনা।
আসল মজা জমল, আর আমরা মজলাম, হাকিম এর সিনে। সিন করতে গিয়ে দেখি মোহর আর রুমাল নেই। ছেলেরা ছুটল আমাদের তালা দেওয়া উপরের তলার রুমে খুঁজতে। ততক্ষন আমরা লাইট নিভিয়ে দাঁড়িয়ে। মিউজিসিয়ানকে বললাম তুই বাজিয়ে যা। ওরা ফিরে এসে বলল, পেলাম না। এদিকে হাকিম চেয়ারে বসে পড়েছে, নড়েনা। বলে, একজন হাকিম, মাটিতে বসব! তাকে বসিয়ে সিন চালু হল। দেখি, মীরমুন্সী ডায়লগ বলছে, “আইয়ে বাবুসাব, কি বেমারি বোলেন, চটাস্‌।” মানে চড় নন্দের গালে না, নিজের গালে, বোঁ করে ঘুরে গিয়ে। দাড়ি চেপে ধরতে গালের, দর্শকের আড়ালে। একটু পরেই শুনি, বলবর ফিসফিসিয়ে বলছে, “আরে খুল রাহা হ্যায়।” সেকি কান্ড, ব্যাটার কি লুঙ্গি খোলে নাকি? না তো, বসে আছে। কি করে হবে। তখন দেখি, হাকিমের দাড়ি প্রায় এক ইঞ্চি নেমে গেছে। হাকিম উসখুস করছে আর অল্প অল্প নাচছে। তারপর এক সাইড ঝপাস, খুলে বুকের উপর। এবার পাবলিকের কি roar of laughter। একবার করে চেপে লাগায় আর আবার খুলে পড়ে। এর মধ্যে রেগেমেগে সে ওদের বানানো জালি ডায়লগেই ফিরে গেছে – নন্দ সামনে আসতেই এক হাতে দাড়ি চেপে অন্য হাত তুলে “খামোশ” বলে চেঁচিয়ে উঠেছে। অবশ্য তা খেয়াল করার মত অবস্থা দর্শকদের ছিলনা। ষোলকলা পুর্ন হল যখন সে “ধুত্তোর” বলে রংবেরঙের দাড়ি টান মেরে ফেলে নগ্নগন্ডে রোল করতে লাগল। লাইট নিভে গেলেও হাসি আর থামেনা। হাকিম বার বার বলছিল, আমার এই কটা মাত্র ডায়ালগ, তাও হাসির না, এতে লোক হাসাব কি করে। সে দুঃখ ঘুচে গেল।

এর পর আমাদের সবার মরাল খুব দমে গেলেও ঠিক করলাম, বাকিটা অন্তত ঠিক করে নামিয়ে মুখরক্ষা করতে হবে। কিন্তু তাতেও যে ভগবান (কোন দিন বিশ্বাস করিনা বলেই বোধহয়) এমন ব্যাগড়া দেবেন কি করে জানব। পরের সিনে পিসিমা দিব্যি কান্নার ভাব করে যাচ্ছিল, হটাৎ নন্দ দুহাত বাড়িয়ে বলে “পিসিমা, তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না।” খাইসে! এ কেমন প্রেমপুর্ন আকুতি! Gerontophilia নাকি? আবার অডিয়েন্স হেসে লুটোচ্ছে।
লোকজন উৎসাহ দিতে লাগল, প্রেমের দৃশ্যটাই তো আসল ক্লাইম্যাক্স, ঠিক করে নামা, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিকও হচ্ছিল। আগেই বলেছি, বিরহ-মিলনের গান আর সানাই জুড়ে এই সিনের music track, আর তার সাথে synchronize করে practice করা হয়েছিল। নন্দ প্রথম বার উঠতেই ল্যাপু অপারেটরকে বললাম, নে চালা। কিন্তু সে যে আগের সিনে মিউসিক fade out দিয়েছিল, সেই volume zero রয়ে গেছে। আওয়াজ আর হয়না। অ্যাক্টররা cue না পেয়ে টেবিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এমন সময় তার হুঁশ হল, volume full করতেই জোরে সানাই। অ্যাক্টররা লাফ দিয়ে চেয়ারে বসে হাত ধরে ফেলেছে দুজনের। দর্শকরা হিন্টটা বুঝেছে, মোটামুটি হাসছে। আমরা বলছি, ওরকমই বসে থাক, লাইট নিভিয়ে একেবারে পরের সিন চালু করে দেব। তখন ল্যাপু অপারেটর, নিজের ভুল বুঝতে পেরে, প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে কেঁচেগন্ডুষ। আবার বিরহের গান থেকে চালিয়ে দিল। আমাদের মাথায় বাড়ি, দর্শকদের পেটে খিল।
লাস্ট সিন আর পরিচয়পর্ব কোনরকমে হল, বিশদে জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেন না। বিদায়ের ডায়লগ বলে দাঁড়িয়ে আছি, লাইট আর নেভেনা। এরকম বার কয়েকই হয়েছিল। কৌশিক ব্যাটাচ্ছেলে excuse দিচ্ছিল শেষে, আমার স্ক্রিপ্ট কে গাপ করে দিয়েছে, লাস্ট ডায়লগ কি তাই জানিনা, সেই মত লাইট নেভাব কি করে। তখন সুযোগ পেয়ে ঝাড় দিয়েছি, আর বলিনি যে ওটা আসলে আমিই নিয়েছিলাম। প্রথম পিসিমা তো তার স্ক্রিপ্ট ঘরে রেখে বাড়ি ভাগল। পরের পিসিমাকে আমার স্ক্রিপ্টটা দিয়ে, কৌশিকের নিজের মাস্টার স্ক্রিপ্টটা ফাঁকতালে নিয়ে নিলাম। আমি ডিরেক্টর, আমার একটা মাস্টার স্ক্রিপ্ট থাকবে না? সবাইকে তো তাদের স্ক্রিপ্ট জেরক্স করে দিতে হল। প্রডিউসার হুওয়া কি কম ঝক্কি! কেউ এক পয়সা ঠেকাবে না। শুধু আর্ট ডিরেক্টর আর্ট পেপার কিনে reimbursement চাইছিল, ঝেঁপে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, সবাইকে বলব, চাঁদা দিতে হবে, ক্লাবের মত। পদত্যাগ/মারের ভয়ে মুখ ফুটে বলিনি। জেরক্স-এর সময় প্রত্যেকে যে টুকু অংশে আছে সেটুকু কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে দিয়েছি। পরে এসে সবাই ঝামেলা করছিল, পুরো গল্প কোথায়, এটুকু পড়ে feeling আসছে না। ওরে, পুরো গল্প পড়বি, কিছু খসা! তা নয়। শেষে আমাকেই গল্প প্রত্যেকবার মুখে বলতে হয়েছিল।

এরপর “পাগলা রাজা নিজেও প্রজাদের হাত থেকে মুক্তি পেলেন, আর প্রজারাও তাঁর স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্তি পেল।” অর্থাৎ আমি ঠিক করলাম, আর এদের সঙ্গে কাজ নয়; আর এরাও বলল, আর জগু ডাইরেক্টরের সঙ্গে সম্পর্ক নয়। জানলাম যে, পরিচালনা করার ইচ্ছা থাকলে গোচালনাও শিখতে হয়।


এটা কিন্তু গল্প হলেও সত্যি। আমাদের কলেজের নাটক করার অভিজ্ঞতাই লিখলাম (আর সেই জন্যেই এটা ব্লগে লেখার যোগ্য)। যেরকম “চিকিৎসা সঙ্কট” করেছিলাম, তাকে “চিকিৎসা বিভ্রাট” বলাই ভাল (যেটা লোকে ভুল করে প্রায়ই বলত, ফলে যাবে ভাবিনি)। অবশ্য সব নামগুলোই একটু পালটানো, আর লেখাটার first person, জগু, কিন্তু আমি নই। আমি কোনটা? Keep guessing...

P.S.: প্রথম লাইনটা – “বসবার জায়গা আছে” – নেপাল ডাক্তারের বলা প্রথম লাইন।

1 comment:

Lazyboy said...

লেখার কায়দা বেশ ভালোই। তবে এটা যদি সত্য ঘটনা হয়ে থাকে, তাহলে আসল লোকেদের সাথে আলাপ করে আসল কথাগুলো জানার ইচ্ছা রইলো। বিশেষত লেখক যখন বক্তা বা মূল চরিত্র নয়।