আ মরি বাংলা ভাষা - তোমার বাঁচার নাইকো আশা -
দাদাঠাকুর এই বিধান লিখে গেছিলেন ৫০ বছরেরও আগে, যে রুগির বাঁচার আশা আর নেই; কিন্তু কবে মরবে তা পরিষ্কার করে বলেন নি। আমরাও এখনো বলতে পারছি না, তবে এই আশা রাখি যে যেমন আসুরিক চিকিৎসা চলছে তাতে সেই শুভদিনের বেশি দেরি নেই।
বিশ্বাস করুন, বাংলা থেকে ণ, ষ এসব ব্যঞ্জনবর্ণ, এমনকি ঈ ঊ এসব স্বর যা আমরা আর উচ্চারণ করি না, বাদ দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। এতে বাংলা লেখা ও শেখা অনেক সোজা হবে। এবং এ শুধু আমার মত নয়, পাকা মতন প্রমাণ দিয়ে বলছি। বঙ্কিম প্রশ্ন করছেন, পোলাপান কি মায়ের কাছে "মাতঃ, দুগ্ধ প্রদান কর" বলে দুধ চাইবে? মুজতবা আলী তাঁর 'সত্যপীরের কলমে' লিখেছেন - ১১ ভল্যুম ঘেঁটে বার করলুম - আমরা ঞ, ণ, ষ, অন্তস্থ বর্ণ গুলি, দীর্ঘ স্বর ইত্যাদির উচ্চারণ দিয়ে ছাত্র এবং পরলোকগত সংস্কৃত কবিদের আত্মা দুজনকেই কষ্ট দিই। বাংলা অ্যাকাডেমি এখন এই দিকে সদর্থক পদক্ষেপই নিচ্ছেন।
তাহলে এমন কথা বলা কেন? কারন, এই জুন ২০০৪ এ আমরা দেখলাম এক দল লোক, গুন্ডা বলাই শ্রেয়, হাঙ্গামা করছে এই বলে যে বড় বড় দোকানের নাম, বিজ্ঞাপন, পোস্টার বাংলায় চাই।

ভাল কথা। কিন্ত যেগুলো বাংলায় লেখা হচ্ছে, তার যে কি তথৈবচ অবস্থা, তার খোঁজ কেউ রাখে না। সরকার, দোকানদার, জমাদার সবার একই দশা। এইখানে এরকম এক গুচ্ছ উদাহরণ দিচ্ছি।
১। সরকারী নোটিস - রামপুরহাট ট্রেন স্টেশনে:

অগ্রিম হয়েছে আগ্রমি, তাও ই-কার এর টিকি গ এর ঘাড়ে চলে গেছে।
২। এই ৩ টে ছবি বাংলা দূরদর্শন এর খবর এর, তলার news flash থেকে নেওয়া:



বানিজ্য কে বানির্জ্য, খুন কে খূন, মার্কিন কে মর্কিন (মর্টিন লেখেনি তাদের ভাগ্য ভাল) করা হয়েছে। জানিনা, খূন লিখলে গুরুত্ব টা বাড়ে হয়ত, ঊ-কার বলে কথা।
৩। এইবার একটা নমুনা বঙ্গদেশের ভোটরঙ্গ থেকে:

প্রতীক 'প্রতিক' রূপে প্রতিভাত হয়েছে। যদি সর্বত্র ঈ-কার বর্জন করত, তা হলে কোন ঝামেলা ছিল না, কিন্তু আবার 'প্রার্থী' লেখা হয়েছে।
৪। কলকাতার বাস চিরকালই নানা রকম graffiti-র জন্য বিখ্যাত। আর তার মধ্যে ভুল এর ছড়াছড়ি। দুটো উদাহরণ:


'দায়ীত্ব' প্রায়ই দেখা যায়, তাই বোধহয় কেউ বাসে নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে সচেতন হননা। এবং সেই দায়িত্বাভাব শুধু নিজেদের মালপত্রের প্রতি নয় - বৃদ্ধ বা অসুস্থকে সিট ছেড়ে দেওয়া, কিংবা ইভটিজিং-এর বিরোধিতা করা - সবেতেই । তবে 'পোকেট' এর এই অবস্থা দেখলে চিন্তিত 'হোইতে'-ই হবে।
৫। একটি ড্রাইভিং শিক্ষামূলক দেওয়াল-লিখন:

এমন খাঁড়া দিয়ে শিক্ষার্থী বলি হয় কিনা, জানতে ইচ্ছা করে। হয় হয়তো, তাই তাদের দিল মাঙ্গে 'মোর'।
৬। এবারে কিছু বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন না বাংলা ভাষার গনধর্ষণ জানিনা। দেখাই:

যে দোকান এমন 'পোসাক' বেচে তাদের বস্ত্রহরণ করাই উচিত।

ঘড় তো এক রকম আওয়াজ - গলা ঘড় ঘড় করে, আলমারি টানার সময় ঘড় ঘড় করে। সেটা ভাড়া দেওয়া মুশকিল। তাহলে বোধ হয় এই সহৃদয় বিজ্ঞাপনদাতা তাঁর ঘাড়টি ভাড়া দেন।

এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই খুব (নাকি খূব) দক্ষ - ইনি দূর থেকেই আভাষ (আভাস) পান যে কারা বিবাহেচ্ছু, তাই তাঁর দূরাভাষ দিতে দূরভাষ (টেলিফোন) নম্বর দিয়ে রেখেছেন। তবে কোয়ার্টার কে 'কোর্য়াটার' লেখায় তাঁকে খুঁজে পেতে ঝামেলা হতে পারে।
আগের গুলো সব ছিল typo। এইবার দেখাই এক মহান শব্দের জাদুকরের কীর্তি:

শৈল, অর্থাৎ পাহাড়ে ঢাকা শহর! আমরা তো জানতাম যে শহর পাহাড়ের উপর, বা কোলে অবস্থান করে, আর বরফ, গাছপালা, ধুলো, কুয়াশা এসবে ঢাকা পড়ে। এবার দেখলাম, পাহাড়েও ঢাকা পড়ে। সত্যি, আমাদের ভূগোল জ্ঞান কত কম!
৭। শেষ করি বইমেলা ২০০৮ এর এক দোকানের বিশাল অক্ষরে লেখা বই এর লিস্ট দিয়ে:

কোন কালী-দাস এর কথা বলছে - রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত না রামকৃষ্ণ? সঞ্চয়িতা হয়েছে সষ্ণয়িতা। শ্রীমদ্ কে কেটে শ্রী আর মদ (আহা কি আনন্দ) আলাদা করা হয়েছে, তারপর সেই মদ ভগবদ-র সঙ্গে জুড়ে ভক্তিতে গদগদ হয়েছে। সাধে কি আর ধর্মকে নেশার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রোগের লক্ষণ গুরুতর। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাংলা ভাষা যে মারা যাবে, তারপর বাংলার লোক কি ভাষায় কথা বলবে? বোবা হয়ে তো থাকবে না। উত্তর হল, বঙ্গভাষা প্রেতরূপ প্রাপ্ত হয়ে বংভাষা হবে। তার শব্দভান্ডার তৈরি হবে ঝাক্কাস, বিন্দাস বা funky, hottie নিয়ে। এরা অজ মানে তো জানবেই না, bovine মানে ও জানবে না। ভাবছেন, তাও কি হতে পারে? এত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গজাচ্ছে চারিদিকে, তার ফল যাবে কোথায়? তাহলে দেখুন:
১। আবার শুরু করি সরকারী দলিল দিয়ে:

CESC (ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই)-র website এ consumer কে cosumer করে consummate দক্ষতা দেখানো হয়েছে।
২। মোবাইল এর রমরমার যুগে কোনো পাপে top-up 'topap' হয়েছে :

৩। ইনি অত্যন্ত দক্ষ চিত্রশিক্ষক হতে পারেন কিন্তু portrait কে potrate লিখলে থিয়োরী-তে নম্বর কাটা যাবার সম্ভাবনা:

অনেক কষ্ট করে ক্যালকাটা কে কলকাতা করা হল। কিন্তু অবাঙ্গালীরা যখন কোওল্কাতা বলেন, তখন মনে হয়, যে এর থেকে কল্কত্তা-ই ভালো ছিলো।
আপাতত এই দিয়ে বাঙ্গালা ভাষার স্মৃতিতর্পণ করলাম। সবাই মিলে গান:
"মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বং-এর ভাষা।"
(ছবি দিয়ে সাহায্য করেছে মৃগাঙ্ক ও চন্দন)
2 comments:
কি মজা,কি মজা............আমি একাই ভুল করিনা তাহলে! সেটা ভেবে অনেকে হয়ত আনন্দ পাবে তোর এই ব্লগটা দেখলে। বাংলা না জানার লজ্জাও চলে যাবে বেশ কিছু ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেপুলের...তবে কিছুই পালটাবেনা এবং অবস্থা আরো সঙ্গিন হবে বলেই ধারণা আমার। এছাড়া আর কিছুই বলার নেই আমার এবিষয়ে। ভালো প্রচেষ্টা।
hum.. thik i
Post a Comment